আজকের দিন কেমন যাবে ?

28th March 2020 ভাগ‍্যচক্র
আজকের দিন কেমন যাবে ?


লকডাউনে বাড়ীতে বসে সময় কাটাতে পড়ুন গল্প

আজকের গল্প - প্রতিদান

লেখা - তারিফ আলম

নার্স মিলন বাবুর হাতে একটা কাগজের টুকরো ধরিয়ে দিয়ে বললেন ," এই ইনজেকশন টা কিনে আনুন তাড়াতাড়ি , তা না হলে আপনার স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হবে না "।
মিলন বাবু একবার স্ত্রীর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বোলালেন ,এখনও জ্ঞান ফিরে নি । গতকাল রাতে আচমকাই বুকে ব্যাথা শুরু হয়ে যায় । গ্রামের হাতুড়ে ডাক্তার গজানন দেখে বলে যে দ্রুত মেদিনীপুর হসপিটালে নিয়ে যান , দেরি করলে আর রক্ষে নাই । তাই ভোরে ট্যাক্সি ভাড়া করে স্ত্রীকে গ্রাম থেকে মিলন বাবু মেদিনীপুর হসপিটালে নিয়ে এসে ভর্তি করেছেন ।
গ্রামের একজনের ফোন থেকে ছেলে অরবিন্দকে ফোন করেছিলেন । কিন্তু মিলন বাবু কথা বলার আগেই ছেলে ব্যস্ত আছি বলে ফোন কেটে দিয়েছিল । আরও কয়েকবার ফোন করলেও সে ফোন তুলে নি । একমাত্র ছেলে মেদিনীপুর শহরে একটা নামী কোম্পানিতে ম্যানেজার , বউ আর তার এক ছেলে রবি কে নিয়ে মেদিনীপুর এ থাকে । মাসে মাসে ৩ হাজার টাকা করে গ্রামে পাঠায় বৃদ্ধ বাবা মা এর জন্য । এই ভাবেই সে তার বাবা মা এর ভালোবাসার প্রতিদান দিয়ে চলেছে ।

মিলন বাবু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে ওষুধ দোকানে গিয়ে কাগজ টা দেখাতে ওষুধ দোকানী ইনজেকশন এর দাম বলে ১২০০ টাকা । কিন্তু মিলন বাবুর কাছে মাত্র ১৫০ টাকা মতো বাকি আছে । যা ছিল তা গাড়ি ভাড়া আর অন্যান্য ওষুধ করে সব শেষ হয়ে গিয়েছে । তাই আর দেরি না করে ছেলের বাড়ীর উদ্দেশ্যে একটা অটো ধরে রওনা দিলেন । অনেক দিন পূর্বে একবার ছেলে নিয়ে এসেছিল তার ভাড়া বাড়ীতে । মিলন বাবু যথাস্থানে পৌঁছে বাড়ীতে গিয়ে দেখলেন অচেনা সব মানুষ ।
তিনি একজন কে তাঁর ছেলে অরবিন্দ এর কথা জিজ্ঞাসা করলেন । সে বলল যে , অনেক দিন আগে তাঁর ছেলে নাকি ভাঁড়া বাড়ী ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে গিয়েছে ।
মিলন বাবু ওখানে উপস্থিত সকলকে তাঁর ছেলের ফ্ল্যাট এর ঠিকানা দয়াকরে জানানোর জন্য বললেন । কিন্তু কেউ অরবিন্দের নতুন ফ্ল্যাট এর ঠিকানা জানে না বলল ।
হতাশ হয়ে মিলন বাবু হসপিটালে ফিরে এলেন ।
অসুস্থ স্ত্রী এর কাছে যেতে দেখলেন তার জ্ঞান ফিরেছে , এবং ‘অরি’ ‘অরি’ করছে । অরি হল তাদের ছেলে অরবিন্দ এর ডাক নাম । স্ত্রী এর দু চোখ দিয়ে অশ্রু বের হচ্ছে ক্রমাগত । বুকে খুব ব্যাথা অনুভব করছে ।
মিলন বাবু স্ত্রী এর কষ্ট দেখতে পারলেন না । । নার্স মিলন বাবু কে দেখে জিজ্ঞাসা করলো ইনজেকশন তিনি এনেছেন কিনা ।
মিলন বাবু মাথা নেড়ে ‘ না’ বললেন ।
নার্স আবার তাড়া দিলেন আর বললেন , তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন , না হলে আপনার স্ত্রীকে বাঁচানো যাবে না ।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে এলেন । সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে নিজের ছেলের খোঁজ করতে করতে । ১১০০ টাকা আরও দরকার ইনজেকশন কেনার জন্য । কি করে যে টাকা টা জোগাড় করবেন তা ভেবে পাচ্ছেন না । এখন দুর্গা পূজা চলেছে । তাই রাস্তায় অনেক মানুষের আনাগোনা । পাশেই একটা বিশাল পূজা প্যান্ডেল । খুব সুন্দর লাগছে । মিলন বাবু দেখলেন একটা বুড়ি পূজা প্যান্ডেল যাওয়ার পথের ধারে বসে আছে একটা থাল মাটিতে রেখে । পূজা দেখতে আসা মানুষ জন সেই থালাতে এক টাকা , দু টাকা , ৫ টাকা ভিক্ষে দিয়ে যাচ্ছে ।
মিলন বাবু আর দেরি না করে সেই ভিখারিনীর পাশে মাটিতে নিজের গামছা টা পেতে দিয়ে বসে পড়লেন । একটু পরে তার পাতা গামছাতেও এক টাকা দু টাকা ভিক্ষে পড়তে লাগলো ।
নিজের স্ত্রীকে বাঁচানোর জন্য আজ ভিখারি হতেও লজ্জা করলো না মিলন বাবুর । এমন সময় ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বাচ্চা ছেলে মিলন বাবুর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে , তার বাবা মা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো ,' ঐ দেখ দাদু" ।
মিলন বাবু দেখলেন , তাঁর ৫ বছরের নাতি রবি আর ছেলে অরবিন্দ ও বউ মা নতুন কাপড় পরে ঠাকুর দর্শনে বেরিয়েছে । সঙ্গে আরও কিছু লোক ।
অরবিন্দ বাবাকে ভিক্ষা করতে দেখে খুব রেগে কটমট করে বাবার দিকে চাইল ।
মিলন বাবু ছেলে কে দেখে বললেন, তোর মা খুব অসুস্থ , হসপিটালে ভর্তি আছে ।
অরবিন্দ এর পাশে থাকা তার কোম্পানির বস অরবিন্দকে প্রশ্ন করলো , ঐ বুড়ো ভিখারিটা কে ?
অরবিন্দ না চেনার ভান করে বলল , "জানি না , কোন পাগল ভিখারি হবে "। এই বলে ছেলে রবিকে কাছে টেনে নিয়ে মিলন বাবুর গামছায় একটাকা ভিক্ষা ছুড়ে দিয়ে অফিসের বস আর তার পরিবার এর সঙ্গে পুজা মণ্ডপের দিকে দ্রুত চলে গেল ।
ছেলের ব্যবহারে মিলন বাবুর দুঃখে কষ্টে দু চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো । তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না । সেখান থেকে উঠে হসপিটালে চলে এলেন । দেখলেন স্ত্রী চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে । দু গালে অশ্রুর রেখা শুকিয়ে গিয়েছে । বহু কষ্টের বর্ষণ হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে ।
মিলন বাবু স্ত্রী এর পাশে বসে খুব ধীর কণ্ঠে শুধু বললেন , অরি এল না গো । তাকে তোমার কাছে আনতে পারলাম না । এই বলে স্ত্রী সীমার মাথায় হাত দিলেন । খুব ঠাণ্ডা । ভয়ঙ্কর ঠাণ্ডার ভয়ে তার মাথা নিজের কোলে তুলে নিলেন । এমন সময় একজন নার্স এসে বলল যে , আপনার স্ত্রী এক ঘণ্টা আগেই মারা গিয়েছেন ।
শুনে মিলন বাবুর কষ্টে বুক যেন ফেটে গেল । তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন । পূজার হই হুল্লোড় আর মাইকের শব্দে তাঁর কান্নার আওয়াজ কেউ শুনতে কি পাচ্ছেন ?





Others News